পেলে: ফুটবল সম্রাট ৪৫ বছর আগে যেদিন কলকাতার মাঠে খেলেছিলেন – BBC News বাংলা

কলকাতা নিউজ

ছবির উৎস, Satyen Sen / BBC

কলকাতা ফুটবলে দলবদলের মরসুম ছিল ১৯৭৭ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি।

ব্যাক ভলি আর বাইসাইকেল ভলির জন্য বিখ্যাত ফুটবলার শ্যাম থাপা তার আগের অনেকগুলো বছর ধরে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে খেলছিলেন। কিন্তু সেবার চির প্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান তাকে দলে নিতে চাইল অনেক টাকার বিনিময়ে।

“প্রথমে রাজী হই নি মোহনবাগানের অফারে। ইস্টবেঙ্গল আমার পুরনো দল, ওরাও আমাকে সমান অঙ্কের টাকা দেবে বলল,” তিনি বলেন।

”কিন্তু যখন মোহনবাগান আমাকে বলল যে তারা পেলেকে নিয়ে আসছে একটা প্রদর্শনী ম্যাচের জন্য, তখন ইস্টবেঙ্গলের কবল থেকে কোনও মতে পালিয়ে মোহনবাগানে সই করি। ফুটবল সম্রাটের সঙ্গে খেলতে পারব, এই সুযোগ কেউ ছাড়ে?” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন শ্যাম থাপা।

বিবিসি বাংলায় আরও পড়তে পারেন

নিউ ইয়র্ক কসমস নিয়ে কলকাতা

যখন ফুটবল বিশ্ব তার সম্রাট পেলেকে স্মরণ করছে, তখন কলকাতা ময়দান ফিরে তাকাচ্ছে প্রায় ৪৫ বছর আগের এক বৃষ্টি ভেজা দিনের দিকে।

কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ১৯৭৭ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক কসমস দলের হয়ে খেলতে নেমেছিলেন  এডসঁ আরান্তেস দো নাসিমেন্তো, পেলে নামেই যাকে চেনে সারা দুনিয়া।

পেলে, বেকেনবাওয়ার প্রমুখ তখন যুক্তরাষ্ট্রে ফুটবলকে জনপ্রিয় করে তুলতে নিউ ইয়র্ক কসমস ক্লাবে খেলেন।

এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ ঘুরে কলকাতায় নেমেছিল কসমস ক্লাব। বেকেনবাওয়ার জাপান থেকেই ফিরে গিয়েছিলেন, আর কলকাতায়  দলের সঙ্গে এসেছিলেন পেলে।

পেলে যখন কলকাতা বিমানবন্দরে নামেন, তখন আনন্দবাজার পত্রিকার অবসরপ্রাপ্ত ক্রীড়া সাংবাদিক চিত্ত বিশ্বাস, যিনি তার ছদ্মনাম চিরঞ্জীব হিসাবেই বেশি পরিচিত, তিনি হাজির ছিলেন সেখানে।

“রানওয়েতে, গোটা বিমানবন্দরে হাজার হাজার মানুষ পেলেকে দেখার জন্য। একটা হুড খোলা জিপে চাপিয়ে তাকে শহরে আনা হচ্ছিল, তিনি বলেন।

পেলের সঙ্গে গাড়ী বহরে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী। তিনি চিরকালই মোহনবাগান সমর্থক।

”রাস্তায় তার গাড়ি থামিয়ে অভ্যর্থনার ব্যবস্থা হয়েছিল অনেক জায়গায়। কিন্তু এত ভিড় হয়েছিল যে মি. চক্রবর্তী ঠিক করেন যে ঘুরপথে পেলেকে নিয়ে আসা হবে গ্র্যান্ড হোটেলে,” বলছিলেন চিরঞ্জীব।

প্রায় মাঝরাতে হোটেলের সামনেও কয়েক হাজার মানুষ পেলেকে দেখার জন্য ভিড় করেছিলেন।

সেই সময়ে পেলে নিউ ইয়র্ক কসমস ক্লাবের হয়ে খেলতেন

ছবির উৎস, Getty Images

পেলের খেলা দেখতে পাগল

অন্যদিকে অনেক আগে থেকেই পেলের দলের মোকাবিলা করার জন্য প্র্যাকটিস করছিলেন মোহনবাগানের ফুটবলাররা।

“পেলের বিরুদ্ধে খেলতে নামছি, এ কি যে সে ম্যাচ! পি কে ব্যানার্জী আমাদের কোচ ছিলেন তখন। সব কিছু ছকে ফেলা হয়েছিল যে কে কোথায় পেলেকে মার্কিং করবে, কে কভার করবে – সবকিছুই ঠিক ছিল,” বলছিলেন সেই ঐতিহাসিক ম্যাচে মোহনবাগান দলের ক্যাপ্টেন সুব্রত ভট্টাচার্য।

পেলের খেলা দেখার জন্য কলকাতা প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। ম্যাচের টিকিটের জন্য কুপন কাটতে হয়েছিল, যে কুপনের ভিত্তিতে লটারি করে টিকিট বিক্রি করা হয়েছিল।

ইডেন গার্ডেন্স সেদিন কানায় কানায় পূর্ণ। একটা টিকিটের জন্য হাহাকার করছেন ফুটবল পাগলরা।

উত্তর কলকাতার লালাবাগানের এরকমই এক ফুটবল পাগল ছিলেন ‘ভোম্বলদা’।

সিনিয়র সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক রন্তিদেব সেনগুপ্ত তার ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, “ভোম্বলদা তার ছেলের নাম রেখেছিল পেলে। ভোম্বলদা ছিল ইস্টবেঙ্গলের পাঁড় সমর্থক আর অন্ধ পেলে ভক্ত। পেলে আসার কদিন আগে থেকেই উত্তেজিত ছিলেন ভোম্বলদা। কেউ ভোম্বলদাকে টিকিট জোগাড় করে দিতে পারে নি। একখানা টিকিটের জন্য সবারই তখন পাগলপারা অবস্থা।”

১৯৭০ এর বিশ্বকাপ ফাইনালে প্রথম গোল করার আগের মুহুর্তে পেলে (একেবারে ডানে)

ছবির উৎস, Getty Images

সেদিন পেলের খেলা অনিশ্চত

ম্যাচের দিন কলকাতায় বৃষ্টি হয়েছিল। পেলের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মাঠ ঘুরে এসে বলেছিলেন, তিনি ভেজা মাঠে খেলতে পারবে না।

“ইডেন তো ফুটবল গ্রাউন্ড না, ক্রিকেট মাঠ। তাই ওই ভেজা মাঠে পেলে খেলবেন কী না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পেলে বলেন, এই শহরে আমাকে এত মানুষ ভালবাসে, ফুটবলকে ভালবাসে, আমি নামব মাঠে,” বলছিলেন ক্রীড়া সাংবাদিক চিরঞ্জীব।

মোহনবাগান ঘরের টিম, কিন্তু সেদিন গোটা মাঠে একটাই চিৎকার শোনা যাচ্ছিল, ‘পেলে, পেলে’।

“ওই বিশাল সংখ্যক মানুষ, নব্বই হাজার দর্শক, মাঠে পেলে, আমরা ফুটবল খেলব কী! ফুটবলের সম্রাটকেই দেখছি আমরা, কী করে তিনি ড্রিবল করেন, কী করে বল রিসিভ করেন এইসব খুঁটিনাটি শিখে নিতে চেষ্টা করছি। তবে আমি খুব খুশি ছিলাম সেদিন, যে গোল করে দিয়েছিলাম।অন্য গোলটা করেছিল মুহম্মদ হাবিব,” মনে পড়ছিল শ্যাম থাপার।

অনেকেই বলেন ভেজা মাঠের জন্য পেলে তার পায়ের জাদু দেখাতে পারেন নি কলকাতার ফুটবল প্রেমীদের। এছাড়াও তার পায়ের জন্য যে বিপুল অঙ্কের বিমা করা ছিল, চোট পেলে বিমা কোম্পানির কাছে জবাব দিতে হত – একারণেও তিনি একটু হাল্কা চালেই খেলেছিলেন – এমনটাই মনে আছে সেদিন ইডেনের দর্শকদের অনেকের।

তবে তার মধ্যেই পেলের করা সেন্টার থেকে একটা গোল করেছিলেন কসমস ক্লাবের কার্লোস আলবার্তো।

পেলের পায়ের যাদু না দেখতে পেয়ে কলকাতাবাসীর মন ভেঙ্গে গিয়েছিল

ছবির উৎস, Getty Images

‘ইউ আর গুড!’

“আমরা তো ২-১ এ জিতেই যাচ্ছিলাম, ওরা তো পেনাল্টি থেকে গোল করল। ওটা যে পেনাল্টি ছিল না সেটা তো স্বয়ং পেলেই বলেছিলেন,” বলছিলেন মোহনবাগান ক্যাপ্টেন সুব্রত ভট্টাচার্য।

তার কথায়, “পেলে প্লেয়ার হিসাবে কেমন, তা আমার বিশ্লেষণ করার দরকার নেই। কিন্তু এত বড়মাপের একজন প্লেয়ারের সৌজন্য আমাকে অবাক করেছিল যখন ওদের হোটেলে ডিনারে গিয়েছিলাম আমরা। আমাকে দেখেই বলেছিলেন, ক্যাপ্টেন কাম ইনসাইড।”

তবে ম্যাচ শেষে ডিনারে গিয়ে একটু ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলেন সেদিনে অন্যতম গোলদাতা শ্যাম থাপা।

তিনি বলছিলেন, “আমাদের সবার সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। যখন আমার আলাপের পালা এল, তখন আমি বলেছিলাম যে আমি আপনার দলকে একটা গোল দিয়েছি। এটা শুনেই উনি বলেন, ‘ওহ, তুমি গোল করেছ, তোমার সঙ্গে কথা বলব না। আমি তো বেশ ঘাবড়িয়ে গেলাম।”

“তবে পরক্ষণেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, নাম্বার টুয়েন্টি টু, ইউ আর গুড, ইউ আর গুড। আমি অবাক, যে আমার জার্সি নম্বরও মনে রেখেছেন তিনি, আবার বলছেন ইউ আর গুড। ফুটবল সম্রাট বলছেন এটা আমাকে! সেই শব্দগুলো আমার মনে গেঁথে আছে এখনও,” মনে পড়ছিল শ্যাম থাপার।

কলকাতায় দ্বিতীয় সফরে পেলে, ২০১৫ সালে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ও সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে ফুটবল সম্রাট

ছবির উৎস, Getty Images

কলকাতার মন ভেঙ্গেছিলেন পেলে

কিন্তু সাধারণ মানুষের মন ভেঙ্গে গিয়েছিল পেলের পায়ের জাদু না দেখতে পেয়ে।

তবে উত্তর কলকাতার সেই অন্ধ পেলে ভক্ত ‘ভোম্বলদা’র বিশ্লেষণটা একেবারেই অন্যরকম ছিল, লিখছেন প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক রন্তিদেব সেনগুপ্ত।

“জনে জনে ডেকে বলেছিলেন, তরা কি কিসুই বোঝোস না? পেলেরে আমরা এখানে ডাইক্যা আনসি। সে আমাগো অতিথি। অতিথি হইয়্যা আইস্যা আমাগো গন্ডা গন্ডা গোল দিয়া গ্যালে কি হেইডা ভালা দেখায়! হেইর জইন্য ত সে খেলে নাই। পোলাডা খুব ভদ্র কি না,” লিখেছেন রন্তিদেব সেনগুপ্ত।

ম্যাচের পরের দিন ২৫ সেপ্টেম্বর পেলে সহ গোটা কসমস দলই কলকাতা ছাড়ে।

তিনি কলকাতায় নামার দিন যে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন ফুটবল সম্রাটকে একটি বার চোখে দেখার জন্য, কসমস ফিরে যাওয়ার দিন কিন্তু বিমানবন্দর ছিল একদম ফাঁকা।

তবে পেলে আরও একবার ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়, ২০১৫ সালে।

সেবার অবশ্য খেলতে নয়, এ টি কে কলকাতা দলের একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তিনি, আর গিয়েছিলেন সল্ট লেকের যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে একটা ম্যাচ দেখতে।

Source: https://news.google.com/__i/rss/rd/articles/CBMiMWh0dHBzOi8vd3d3LmJiYy5jb20vYmVuZ2FsaS9hcnRpY2xlcy9jNG44M2twZTI0em_SATVodHRwczovL3d3dy5iYmMuY29tL2JlbmdhbGkvYXJ0aWNsZXMvYzRuODNrcGUyNHpvLmFtcA?oc=5