অসীমান্তিক কলকাতা – Barta24.com

কলকাতা নিউজ

যে কোনো শহরের একটা অদৃশ্য বিভাজন রেখা থাকে। যা শহরটাকে ভাগ করে। নিউইয়র্কের আছে, দিল্লির আছে। আমাদের কলকাতারও আছে: উত্তর বনাম দক্ষিণ।

দৃশ্যত ভৌগোলিক হলেও এ ভাগ মননশীলতার। এ ভাগ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির। এ ভাগ সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক। আজকের কলকাতায় দাঁড়িয়ে হয়তো খ্যাতির, বিত্তের এবং প্রচারের আলোকে টেনে নেওয়ারও। কিন্তু তারপরেও কিছু বিষয় থেকে যায় ঐতিহ্য, আত্মিক এবং বৌদ্ধিক অনুশীলনের।

এই সব কিছুকে কেন্দ্র করে শহরের একটা ভাগ আরেকটা অংশের সঙ্গে পাল্লা দেয়। প্রতিনিয়ত একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে। একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার।

আমাদের ছোটবেলায় আনন্দবাজার পত্রিকা রবিবাসরীয়তে উত্তর বনাম দক্ষিণ নিয়ে চমৎকার দুটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। দক্ষিণের হয়ে লিখেছিলেন একদা উত্তরের বাসিন্দা, পরে গড়িয়াহাটের ম্যান্ডেভিলা গার্ডেনস লেনে চলে যাওয়া কিংবদন্তি কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আর উত্তরের গলি থেকে ঐতিহ্য, সব নিয়ে কলম ধরেছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য।

কিন্তু সেটা গত শতকের আটের দশকের কথা। পরের ৩০ বছরে কলকাতা শহরের দাড়িপাল্লাটা এতটাই দক্ষিণের দিকে ঝুঁকে গেছে যে উত্তর এখন নেহাতই দুয়োরানি! রাজনৈতিক এবং সামাজিক গুরুত্বের দিক থেকে শহরের উত্তরভাগ কিছুতেই দক্ষিণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারে না। কলকাতা আড়ে এবং বহরে যেভাবে বেড়েছে তাতে সল্টলেক, রাজারহাট, নিউটাউন মিলিয়ে পূর্ব কলকাতা যেমন অবয়ব নিয়েছে, তেমনই বাইপাসের পাশ বরাবর রুবি থেকে গড়িয়া পর্যন্ত জনপদের বিকাশ আসলে দক্ষিণ কলকাতার সঙ্গেই সংযুক্ত হয়েছে, দক্ষিণকেই সমৃদ্ধ করেছে। তাই গত শতকের আটের দশকে যে সব প্রতর্ক তুলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দক্ষিণকে এগিয়ে রেখেছিলেন, সেগুলোই আরো শক্তিশালী হয়েছে। দলবদলের মতোই শিকড় ত্যাগ করে উত্তর ছেড়ে দক্ষিণে যাওয়ার প্রবণতা কলকাতায় ক্রমবর্ধমান।

এ প্রসঙ্গে একটা কবুলনামা দিয়ে রাখা ভাল। আমার জীবনের শৈশব, কৈশোর উত্তর কলকাতায় কাটলেও গত দুই দশক ধরে ঠিকানার দিক থেকে আমি দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। তাই শহরের উত্তর বনাম দক্ষিণের ভাগাভাগিতে আমি কোনো পক্ষেই পরি না। কোনো দিকে ঝোঁকাটাও আমার জন্য একটু মুশকিল। আরও মজার বিষয় হল গত কয়েকবছর ধরে পারিবারিক কারণে ঠিকানা ছেড়ে যেখানে পরবাসী হয়েছি, সেটা মধ্য কলকাতা। তাই আমি শহরের বিভাজনরেখায় দাঁড়িয়ে উত্তরের কূল গৌরব এবং তেলেভাজাকে চেটেপুটে খাই, আবার দক্ষিণের আধুনিকতা ও ফিশ এন্ড চিপসকে জীবনে ঢুকিয়ে নিয়েছি এবং নিজেকে উত্তর ও দক্ষিণের আসা যাওয়ার মাঝখানে রেখে ঝক্কিকে এড়াতে চেয়েছি।

এই পর্যন্ত পড়ে যদি কেউ মনে করেন, আমিও তাহলে নিজের শিকড় এবং দুয়োরানী উত্তর কলকাতাকে ত্যাগ করেছি, তাহলে কিন্তু প্রতিবাদ করব। বাঙালি যেমন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, সিমলে পাড়ার দুর্গাপুজো, কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের গন্ধ আর ইনফিউশনকে ভুলতে পারবে না, তেমনই আমার মতো হাফ সেঞ্চুরির দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া মানুষের পক্ষেও উত্তর কলকাতার অতীতকে ভোলা কঠিন। হট এন্ড হ্যাপেনিং দক্ষিণ কলকাতার বাস্তবকে মেনে নিয়েও। শ্যামপুকুরের গলিতে যে দেওয়ালে লেখা থাকত তেলেভাজাকে ভোট দিন অথবা নকুড়ের মিষ্টির দোকানকে জোর করে বন্ধ করতে গেলে দোর্দন্ড প্রতাপ পুলিশ অফিসারকেও বদলি হয়ে যেতে হয়, সেটা জানি বলেই বলছি। দুবাই যেমন কখনও প্রাগ হতে পারবে না, ফ্লোরিডা যেমন কখনও মোনাকোতে মধুচন্দ্রিমার গ্ল্যামার দিতে পারবে না, সেইরকমই আর কি!

তাহলে কি আমি উত্তরের ই পক্ষে? দক্ষিণকে আপস্টার্ট বলে উপেক্ষার দলে?

বোধ হয় সেটাও না। কারণ ঐতিহ্যের সঙ্গে দাড়িপাল্লায় উৎকর্ষকেও যে রাখতে হয়। তা না হলে ম্যানহাটন বা টাইমস স্কোয়ারকে দেখে মুগ্ধ হই কেন?সেই কারণেই গড়িয়াহাটের মোড়ের মিনি মিনিবাস এবং আরো সবকিছুতে সমানভাবে আকর্ষিত হই।

ওই জন্যই বলেছি না, হাফ সেঞ্চুরিতে পৌঁছে আমি নিজের পজিশন চেঞ্জ করে নিয়েছি। শহরের বিভাজন রেখাটায় দাঁড়িয়ে দু পাশের সেরাটা পেতে চাই। উত্তরের এবং দক্ষিণেরও। সম্ভব হলে পূর্ব এবং পশ্চিমেরও! আমার কাছে, কলকাতা অসীমান্তিক। অবিভাজ্য। আমার ‘কলকাতা আছে কলকাতাতেই’!

সুমন ভট্টাচার্য, কলকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিক। কবি, কথাশিল্পী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। 

Source: https://barta24.com/details/debates/131365/infinite-calcutta