ভুয়া টিকায় তোলপাড় কলকাতা – The Daily Star Bangla

কলকাতা নিউজ

কলকাতা মহানগরীতে এক ভুয়া আইএএস অফিসারের উদ্যোগে ভুয়া টিকাকেন্দ্র চলছে, তা মানুষের অজানাই থেকে গিয়েছে দিনের পর দিন। ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য, নায়িকা মিমি চক্রবর্তী সেই ভুয়া টিকার শিকার না হলে একটা ভয়ংকর অসাধু চক্র এবং তার আড়ালে কলকাতার পাইকারি ওষুধের বাজার বাগড়ি মার্কেটে নকল ওষুধের কারবার মানুষের অজানাই থেকে যেত।

কলকাতার কসবা অঞ্চলে নিজেকে আইএএস অফিসার বলে পরিচয় দেওয়া দেবাঞ্জন দেব আয়োজিত একটি টিকাদান শিবির থেকে কোভিডের টিকা নেন তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য মিমি চক্রবর্তী। টিকা নেওয়ার পর কয়েকদিন কেটে গেলেও মিমির মোবাইলে কোনো মেসেজ আসেনি। বিষয়টি ঘিরে সন্দেহ তীব্র হওয়ায় তিনি পুলিশকে বিষয়টি জানান।

পুলিশের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শিবিরটির আয়োজক দেবাঞ্জন নিজেকে আইএএস অফিসার হিসেবে পরিচয় দিলেও আদৌ তিনি তা নন। সেই শিবিরে দেওয়া ভ্যাকসিনের ভাওয়ালগুলো পরীক্ষা করে প্রাথমিকভাবে পুলিশ বুঝতে পারে, সেগুলো আসলে কোভিডের ভ্যাকসিনই ছিল না। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, কোভিডের ভ্যাকসিন বলে হামের প্রতিষেধক সেখানে দেওয়া হচ্ছিল।

পুলিশ ভুয়া আইএএস দেবাঞ্জনকে গ্রেপ্তারের পর জানতে পারে, কলকাতার পাইকারি ওষুধের বাজার বাগড়ি মার্কেট থেকে শিবির পরিচালনার জন্যে ওষুধ সংগ্রহ করা হতো। সেই ওষুধ রিকুইজিশনের জন্যে স্বাস্থ্য দপ্তর ও কলকাতা করপোরেশনের নকল প্যাড ইত্যাদি তৈরি করেছিলেন দেবাঞ্জন। অন্য ভ্যাকসিন কিনে সেসব ভ্যাকসিনের ভাওয়াল থেকে ওষুধের নাম তুলে তার গায়ে ‘ভুয়া ভ্যাকসিন’র নামের স্টিকার লাগিয়ে দেওয়া হতো। দেবাঞ্জনের অফিসে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ সরকারি প্যাডসহ অনেক কিছুই জব্দ করেছে। এই কাজে দেবাঞ্জনের বেশ কয়েকজন বেতনভোগী কর্মীও ছিল বলে পুলিশের তদন্তে জানা গেছে।

কেবলমাত্র কসবাতেই নয়, উত্তর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের সিটি কলেজেও দেবাঞ্জনের উদ্যোগে কোভিড ভ্যাকসিনেশন শিবির হয়েছে। সেখানেও ভুয়া ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে বলে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। ওই শিবিরেও সিটি কলেজের ৭০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।

রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে ভুয়া আইএএস দেবাঞ্জনের ঘনিষ্ঠতার বেশ কিছু তথ্যপ্রমাণ কলকাতার খবরের কাগজগুলোতে ও ফেসবুকে ইতোমধ্যেই উঠে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের অত্যন্ত প্রভাবশালী মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও দেবাঞ্জন একসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি মূর্তি পর্যন্ত উন্মোচন করেছিলেন। সেই উন্মোচন ফলকে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে আইএএস অফিসার হিসেবেই দেবাঞ্জনের নাম ছিল। ভ্যাকসিন শিবিরে জাল প্রতিষেধক দেওয়ার বিষয়টি সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই রবীন্দ্রমূর্তির ওই উন্মোচন ফলক টিকে একেবারে উপড়ানো অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে সম্পর্কে ফিরহাদ হাকিম জানান, মূর্তি উন্মোচনে কে থাকবে না থাকবে, সেটি দেখার দায়িত্ব আয়োজকদের।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সচিব বলে পরিচয় দিয়ে একজন ভুয়া ব্যক্তি রাজ্য সরকারের একজন মন্ত্রীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মূর্তির উন্মোচনে হাজির থাকতে পারার ভেতর দিয়েই বোঝা যাচ্ছে, দেবাঞ্জনের শাসক শিবিরের ভেতরে কতখানি সংযোগ আছে। ফিরহাদ হাকিম ছাড়াও প্রবীণ মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সংসদ সদস্য শান্তনু সেনের সঙ্গেও দেবাঞ্জনের ঘনিষ্ঠতার কথা উঠে আসতে শুরু করেছে।

কলকাতায় পাইকারি ওষুধের বাজার বাগড়ি মার্কেট যে ক্রমশ নকল ওষুধের খোলা বাজারে পরিণত হয়েছে, সেটা এই ভুয়া ভ্যাকসিন শিবির ও তার আয়োজক আইএএস দেবাঞ্জনের কাজকর্মের ভেতর দিয়ে উঠে আসছে। বাগড়ি মার্কেটে ওষুধের যে পাইকারি বাজার আছে, সেখান থেকে কেবল পশ্চিমবঙ্গেই নয়, ভারতের পূর্বাঞ্চলের একটা বিস্তৃত এলাকায় ও বাংলাদেশেও ওষুধ যায়।

পুলিশ ইতোমধ্যে দেবাঞ্জনকে গ্রেপ্তার করেছে। বিশেষ তদন্তকারী দল ‘সিট’ও গঠন করেছে। কিন্তু, অতীতে সারদা চিটফান্ডের আর্থিক কেলেঙ্কারিসহ বহু ক্ষেত্রে এই ‘সিট’র শীতঘুম দেখে সাধারণ মানুষের রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো সংস্থার তদন্ত ঘিরে আস্থার পরিমাণটা খুবই কম।

চলমান অবস্থায় রাজ্য সরকার স্কুল স্তরের মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। সেই রাজ্য সরকারই অবশ্য উপনির্বাচন আয়োজনের জন্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে আবেদন করছে। কারণ, শুভেন্দু অধিকারীর কাছে হেরে যাওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন বিধানসভার সদস্য নন। শপথের ছয় মাসের মধ্যে তিনি জিতে আসতে না পারলে আর মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।

এই অবস্থা যখন রাজ্যের, তখন একমাত্র বামপন্থিরা ছাড়া ভ্যাকসিন কেলেঙ্কারি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের একটি রাজনৈতিক দলও পথে নামেনি। প্রধান বিরোধী দল বিজেপি কাগজে প্রতিবাদ জানিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। অতিবাম দলগুলো মমতার ভোটে বিজেপিকে ঠেকানোর দৌলতে এখন মমতার বিরুদ্ধে একটিও কথা বলে না। কংগ্রেস বামদের সঙ্গে জোট ঘিরে নিজেদের ভেতরে গোপন শলাপরামর্শে মগ্ন। মমতার বিরুদ্ধে ভবাণীপুরের উপনির্বাচনে প্রার্থী না দেওয়ার পক্ষে ইতোমধ্যেই কথা বলতে শুরু করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি, সংসদ সদস্য অধীররঞ্জন চৌধুরী। ফলে ভুয়া ভ্যাকসিন ক্যাম্পের সংগঠকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সত্ত্বেও পার পেয়ে যাচ্ছে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস।

গৌতম রায়, ভারতীয় ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক

Source: https://www.thedailystar.net/bangla/%E0%A6%B6%E0%A7%80%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B7-%E0%A6%96%E0%A6%AC%E0%A6%B0/%E0%A6%AD%E0%A7%81%E0%A7%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%9F%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%A4%E0%A7%8B%E0%A6%B2%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A1%E0%A6%BC-%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE-234305