স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দল গড়তে কলকাতা গিয়েছিলেন রকিবুল – jagonews24.com

কলকাতা নিউজ

‘জয় বাংলা’- স্বৈরাচার পাকিস্তানী হানাদারদের বিপক্ষে মুক্তিকামি বাঙ্গালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল স্লোগান। উনসত্তরের গণ আন্দোলনের পর থেকেই স্বাধীকার আন্দোলনের বীর বাঙ্গালির মুখে বাংলাদেশের জয়োধ্বনি ‘জয় বাংলা।’

৭০ পরবর্তী উত্তাল দিনগুলোতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, রংপুরসহ গোটা দেশ সে স্লোগানে মুখরিত ছিল।

সেই জয় বাংলা স্লোগানকে বুকে ধারণ করে বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে দিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন এক বাঙ্গালি ক্রিকেটার, ক্রিকেট যোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা রকিবুল হাসান। পাকিস্তানীদের বিপক্ষে মুক্তিকামি বাঙ্গালির স্বাধীকার আন্দোলনে নতুন মাত্রা আনতে এক অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন ক্রিকেটার রকিবুল হাসান।

১৯৭১-এর মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাস খানেক আগে পাকিস্তানের হয়ে সফরকারী কমনওয়েলথ একাদশের বিপক্ষে সে সময়ের ঢাকা স্টেডিয়াম তথা আজকের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে জয় বাংলা স্টিকার সম্বলিত ব্যাট নিয়ে খেলতে নেমে সারা পাকিস্তানে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিলেন বাঙ্গালি ক্রিকেট যোদ্ধা রকিবুল হাসান।

তার ‘জয় বাংলা’ স্টিকার সম্বলিত ব্যাট হাতে মাঠে নামার ইতিহাস সবার জানা; কিন্তু মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ওই নয়মাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে বাঙ্গালির স্বাধীকার আন্দোলনে ক্রিকেটারদের ভূমিকা কী ছিল? রকিবুল হাসান কি করেছেন? কোথায় ছিলেন? অন্য ক্রিকেটাররাও কী রনাঙ্গনে পাকিস্তানী হানাদারদের বিপক্ষে মুক্তি সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন?

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দলও যে হবার কথা ছিল, তাই বা জানা আছে ক’জনার? অনেকেরই জানা, রকিবুলেরই সঙ্গী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ওপেনার আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল পাকিস্তানী শত্রুদের বিপক্ষে একদম সন্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। বিখ্যাত ‘ক্র্যাক প্ল্যাটুনের’ অন্যতম সদস্য ছিলেন জুয়েল।

ক্রিকেট ব্যাট ছেড়ে গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে দারুন সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন আবদুল হালিম জুয়েল। পরে যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি এক গেরিলা অপারেশনে শহীদ হন।

জুয়েল যখন ঢাকা ও তার আশপাশে গেরিলা অপারেশনে অংশ নিয়ে পাকিস্তানীদের ব্যতিব্যস্ত রাখছিলেন, তাদের নানা ঘাঁটি ও স্থাপনা ধ্বংসের কাজে ব্যস্ত, রকিবুল তখন ভারতের পশ্চিম বঙ্গের কলকাতায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সঙ্গে ভারতের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে জনসমর্থন আদায়ের কাজে ব্যস্ত।

জাগো নিউজের সাথে আলাপে সেই কঠিন দিনগুলোর কথাই জানিয়েছেন এ ক্রিকেট যোদ্ধা। কিভাবে পায়ে হেঁটে, কখনো বা নৌকায় চড়ে ভারত পৌঁছেছিলেন? ভারতে যাওয়ার পিছনের গল্প শুনিয়েছেন। কে কাতে অনুপ্রাণিত করেছেন, কার নির্দেশে তার ভারত যাত্রা এবং কি লক্ষ্যে তিনি ভারতে গিয়েছিলেন?

জাগো নিউজের সাথে আলাপে তার বর্ননা দিয়েছেন রকিবুল হাসান। ‘মার্চের ২৫ তারিখ পাকিস্তানীরা যখন নিরস্ত্র বাঙ্গালির ওপর হামলা চালাতে শুরু করে, নির্বিবাদে গুলি করে লাখ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করতে শুরু করলো তখনকার আট-দশটা যুবক তরুণের মত আমিও ভাবছিলাম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিব। দেশকে স্বাধীন করতে ব্যাট ছেড়ে অস্ত্র হাতে নিব।

কিন্তু কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় তা করবো ? ভেবে পাচ্ছিলাম না। ওদিকে ঢাকায় থাকাও নিরাপদ না। সাত-পাঁচ ভেবে আমাদের ঢাকার পুরনো ঢাকার শ্যামবাজারের বাসভবন ছেড়ে চলে যাই নিজ গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানিতে।

সেখানেই কথা হয় সে সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ শহীদের সাথে। তিনিও তখন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে অবস্থান করছিলেন। তিনি আমাকে প্রথম বলেন, তুই ভারতে চলে যা, আমিও সেখানেই অবস্থান করছি।

ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের মত ক্রিকেট দল তৈরির কাজ শুরু করে দে। আমি চেয়েছিলাম রনাঙ্গনে যুদ্ধ করতে। শহীদ ভাই আমাকে বোঝালেন, যুদ্ধের সময় যারা দেশ মাতৃকার জন্য কাজ করে তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব কলাকুশলী, শিল্পি, সাংবাদিক, লেখক, কবি সাহিত্যিকদের কথা উল্লেখ করে শহীদ ভাই আমাকে বললেন, দেখ! তারা প্রতিনিয়ত জাতিকে অনুপ্রানিত করছে। উৎসাহিত করছে। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করছে। তারাও মুক্তিযুদ্ধ করছে। তারা ‘শব্দ সৈনিক।’

তুই ক্রিকেটার। ক্রিকেটাররাও ব্যাট-বল হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করতে পারে। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল যেমন করছে তেমন। আমি উৎসাহিত হলাম। তারপর ভারতের কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।

গাড়ী নেই, মোটর সাইকেল নেই। পায়ে হেঁটে, নৌকায় চড়ে অনেক কষ্ট করে বনগাঁ পর্যন্ত গেলাম। এখনো মনে আছে ক্ষুধার যন্ত্রনায় এক গ্রাম্য রেস্তোঁরায় ভাত, ডিম ভাজি, ডাল আর আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম। কিন্তু থাকবো কোথায়? বনগাঁ স্টেশনের কাছে চাটাই কিনে রাত কাটিয়েছি।

তারপর বনগাঁ থেকে কোলকাতায় চলে যাই। সেখানে গিয়ে শহীদ ভাইয়ের (শেখ শহীদ) সাথে দেখা করি। তিনি বলেন, ক্রিকেট দল তৈরি করতে হবে। ঢাকায় যোগাযোগ কর। দেখ ক্রিকেটাররা কে কোথায় আছে? তাদের কোলকাতায় এনে দল তৈরি করে ফেল।

ওদিকে তখনকার প্রায় সব বাঙ্গালি নামী ফুটবলার কলকাতায়। কে নেই? জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, আইনুল, কায়কোবাদ, নওশের, আলী ইমাম, সালাউদ্দীন, এনায়েত, সাইদুর রহমান প্যাটেল প্রমুখরা মিলে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল তৈরি করে ফেলেছে।

যারা পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের মাটিতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল নামে উড়িয়েছিলেন লাল সবুজ জাতীয় পতাকা। পশ্চিম বঙ্গ থেকে শুরু করে ভারতের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ফুটবল খেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতের আপামর জনসাধারনের অকুন্ঠ সমর্থন অদায় করেছেন।

আমিও তাদের সাথে যুক্ত হয়ে গেলাম এবং ক্রিকেট দল সাজানোর কাজ শুরু করে দিলাম।

প্রাথমিকভাবে মনে হলো যে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের মত আমরা ক্রিকেট দলও করতে পারবো। কারণ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সাথে যারা ছিলেন, তাদের ক’জন তখন নিয়মিত ক্রিকেটও খেলে। ঢাকা লিগেই অংশ নিত।

সেই তালিকায় সবার আগে চলে আসে আমার বন্ধুবর তানভির মাজহার তান্না। সে তখন আজাদ বয়েজের নিয়মিত ক্রিকেটার। লেগস্পিনার হিসেবে বেশ সুনাম সুখ্যাতি ছিল তান্নার। বলার অপেক্ষা রাখে না, তান্না ছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার।

jagonews24

কাজেই তাকে ক্রিকেট টিমে পাওয়াই যাবে। আর স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের আরও তিন সদস্য ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেটও খেলতো। কাজী সালাউদ্দীন আহমেদ তূর্যও আজাদ বয়েজের নিয়মিত ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলেন। নওশের উজ্জামান ছিলেন মোহামেডানের ওপেনার।

প্রতাপ দা’ও ফুটবল-হকির পাশাপাশি ক্রিকেট খেলতেন। এর সাথে আমার আরেক বন্ধু হেমায়েত সিদ্দিকী (সাবেক ক্রিকেটার চার্চিলের ভাই, পরবর্তীতে ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব পালন করেছেন) সব মিলে জনা ছয়েক আমরা সেখানেই। কাজেই মনে হলো, আমরা স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দলও তৈরি করে ফেলতে পারবো।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ক্রিকেট দল গঠন করা সম্ভব হয়নি। আমি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সাথেই থেকে গেলাম। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ফুটবল খেললেন আমাদের ফুচবলাররা।’

মুক্তযুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সাথে আজ এ শহর, কাল আরেক শহরে কাটলো সময়। এর মধ্যে দুটি ঘটনা স্মরণীয় হয়ে আছে। মুম্বাইতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সাথে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলেছিলেন মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র তারকারা। তাদের সাথে মাঠে নেমেছিলেন ভারতের সাবেক অধিনায়ক মনসুর আলী খান পাতৌদি।

আমার মনে আছে, আমি ওই ম্যাচ দেখেছিলাম পাতৌদীর স্ত্রী ভারতের নামী অভিনেত্রী শর্মিালা ঠাকুরের পাশে বসে। তার সাথে কথা হয়েছিল।

এর বাইরে আরও একটি ঘটনা মনে দাগ কেটে আছে। তাহলো, এক সময় কলকাতায় জানাজানি হয়ে গেল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সাথে একজন ক্রিকেটার আছে, যিনি পাকিস্তান একাদশের হয়ে সফরকারী কমনওয়েলথ একাদশের বিপক্ষে খেলেছেন।

ব্যাস! আমাকে বলা হলো কলকাতা লিগ খেলতে। আমি কয়েকটি দলে ট্রায়ালও দিলাম। এক সময় কথা হলো মোহানবাগান কর্তাদের সাথে মোহনবাগানের হয়েই কোলকাতা লিগ খেলবো সাব্যস্ত হলো।

এ রকম অবস্থায় বিসিসিআইয়ের কাছে আমার কাগজপত্র পাঠানো হলো। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমি খেলার অনুমতি পেলাম না।

বাংলাদেশকে তখনো ভারত স্বীকৃতি দেয়নি। তাই বাংলাদেশের ক্রিকেটার হিসেবে কলকাতা লিগ খেলার অনুমতি দেয়াও যায় না। আমার আর কলকাতা লিগ খেলা হলো না। তারপরও মোহনবাগানের সঙ্গে সখ্য হলো। মনে আছে ভারতের সাড়া জাগানো ফুটবলার চুনি গোস্বামী মোহন বাগানের হয়ে ক্রিকেট খেলতেন। সাথে শ্যাম সুন্দর ঘোষও ছিলেন। তাদের সাথে কয়েকটি প্রীতি ম্যাচে অংশ নিলাম।

প্র্যাকটিস ম্যাচ খেললাম। তার এক ম্যাচে ৮০ রানের একটি ইনিংসও খেলেছিলাম। এভাবেই কেটেছে আমার মুক্তিযুদ্ধের দিনকাল। আমার পরিবার,বাবা-মা, ভাই-বোন কে কোথায়? বেঁচে আছেন নাকি পাকিস্তানি জান্তারা মেরে ফেলেছে? তাও জানতাম না। তারপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৮ ডিসেম্বর ফিরলাম। স্বাধীন দেশে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম।

এআরবি/আইএইচএস/জেআইএম

Source: https://www.jagonews24.com/sports/cricket/653895