নগরায়নে হারিয়ে যাচ্ছে কলকাতার জলাশয় – DW (বাংলা)

কলকাতা নিউজ

একে একে কলকাতা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পুকুর৷ হারিয়ে যাচ্ছে বলা হয়তো ঠিক নয়, বলা ভালো, মানুষের লোভের শিকার হচ্ছে৷

একটি পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখলে ছবিটা পরিষ্কার হবে৷ কেন্দ্রীয় সংস্থা দ্য ন্যাশনাল অ্যাটলাস অ্যান্ড থেমাটিক ম্যাপিং অরগানাইজেশন দেড় দশক আগে কলকাতার জলাশয় নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল৷ তারও আগের দুই দশকের তথ্যের ভিত্তিতে রিপোর্টটি তৈরি হয়৷ কেন্দ্রীয় সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি কলকাতায় পুকুরের সংখ্যা ছিল প্রায় নয় হাজার৷ গত প্রায় সাড়ে তিন দশকের মধ্যে এই সংখ্যা কমে হয়েছে পাঁচ হাজারের আশপাশে৷ প্রতি বছর শ’দেড়েক পুকুরের মৃত্যু হচ্ছে৷ ফেব্রুয়ারির গোড়ায় যখন পৃথিবী জুড়ে পালিত হয়েছে বিশ্ব জলাভূমি দিবস, তখন কলকাতাকে নিয়ে উদ্বেগ আবার সামনে এসেছে৷

এই বিপুল সংখ্যক জলাশয় হারিয়ে যাওয়ার পিছনে প্রধান কারণ নগরায়ন৷ বাসস্থানের চাহিদা মেটাতে একের পর এক বহুতল ভবন গড়ে উঠছে পাড়ার মধ্যে৷ হঠাৎ উধাও হয়ে যাচ্ছে পুকুর৷ পরিবেশবিদ অধ্যাপক মোহিত রায় এ নিয়ে গবেষণা করেছেন, এই সংক্রান্ত আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গুগল ম্যাপ অনুযায়ী কলকাতায় এখন পুকুরের সংখ্যা সাড়ে চার হাজার এর আশপাশে৷ মূল কলকাতায় এখন পুকুর বোজানোর প্রবণতা কমে গেছে, কিন্তু কলকাতার অধীন প্রান্তিক অঞ্চলে এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি৷ ১৯৯৫ সালে রাজ্য সরকার একটি আইন করেছিল জলাশয় বাঁচাতে৷ তা সত্ত্বেও অসংখ্য পুকুর বাঁচানো যায়নি৷’’

অপরিকল্পিত নগরায়নের পাশাপাশি অধ্যাপক রায় একাধিক কারণের উল্লেখ করেছেন এই সংকটের পিছনে৷ প্রথমত, পুকুরের রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকঠাক হয় না৷ অনেক ক্ষেত্রেই তা অপরিষ্কার অবস্থায় পড়ে থাকে৷ দ্বিতীয়ত, মানুষ ততটা সচেতন নয়৷ এলাকার পুকুর ভরাট হলে যে গণপ্রতিরোধ গড়ে ওঠার কথা, সেটা তেমন দেখা যায় না৷ অতিকায় বিক্রমগড় ঝিল বছরের পর বছর ধরে ক্রমশ আকারে ছোট হয়ে আসছে, সেখানে ভবন নির্মাণ হচ্ছে৷ প্রশাসন উদ্যোগ নিলে পুকুর বাঁচানো সম্ভব বলে মত মোহিত রায়ের৷ অতীতে কলকাতা পুরসভা ড্রোনের মাধ্যমে নজরদারির কথা বলেছিল৷ একটি কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক নজরদারির কথাও ছিল৷ এমনকি পুরসভার পরিবেশ বিভাগের কর্মীরা সাইকেল করে পাড়ায় ঘুরে পুকুরের হাল দেখবেন, এমন পরিকল্পনার কথাও শোনা গিয়েছিল৷ কিন্তু প্রায় সবটাই রয়ে গিয়েছে খাতায়-কলমে৷

অথচ পুকুর ভরাট করলে পরিবেশের যে কী বিপুল ক্ষতি তা অজানা নয়৷ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধিকর্তা তড়িৎ রায়চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুকুর শেষ মানে বাস্তুতন্ত্রেও ইতি৷ জলজ প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে৷ ক্ষতি হচ্ছে আমাদেরও৷ জলাশয়গুলির উপর স্থানীয় জলবায়ু নির্ভর করে৷ পুকুর বুজিয়ে দিলে সেই ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে৷’’ অধ্যাপক রায়চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘ভূগর্ভস্থ জল কমে আসছে৷ তার উপর ভূপৃষ্ঠের জলও উধাও হয়ে গেলে ভবিষ্যৎ খুব খারাপ৷ এখন বৃষ্টির জল সংরক্ষণের কথা বলা হচ্ছে, পাশাপাশি পুকুর বোজানোও হচ্ছে৷ তাতে লাভ কী?” তার বক্তব্য, ‘‘আমাদের উৎসব, ধর্মীয় আচারের একটা বড় অংশ নদী বা জলাশয়-নির্ভর৷ এটাও মারাত্মক ক্ষতি করছে৷ কিন্তু আমরা সচেতন হচ্ছি না৷’’

কীভাবে হতে পারে জলাশয় সংকটের সমাধান? এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই৷ মোহিত রায়ের মন্তব্য, ‘‘পুকুর সংরক্ষণ করতে হবে৷ জলের মান ঠিক রাখতে হবে৷ তার চারপাশে সৌন্দর্যায়ন দরকার৷ তা হলে এলাকার মানুষও পুকুরের প্রতি মমত্ববোধ করবে৷ একেবারে আলাদা একটা সংস্থা দরকার যা শুধু জলাশয়ের দেখাশোনা করবে৷’’ কলকাতায় ১০০টির মতো এমন পুকুর আছে যার সঙ্গে জড়িয়ে শহরের ইতিহাস৷ যারা সেখানে নানা বর্জ্য ফেলছেন, তারা জানেন না সেই অতীতের কথা৷ পরিবেশের পাশাপাশি ইতিহাস সম্পর্কে তাদের সচেতন করতেও পুরসভাকে উদ্যোগ নিতে হবে, এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের৷

Source: https://www.dw.com/bn/%E0%A6%A8%E0%A6%97%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B6%E0%A7%9F/a-56557997